মেঘে ঢাকা আমার শহর

মেঘে ঢাকা আমার শহর, my city is covered in clouds, যখন ধোঁয়া মেঘে ঢাকা আমার মন, মেঘে ঢাকা তারা, মেঘে ঢাকা আকাশ, মেঘে ঢাকা তারা উপন্যাস, শহর নিয়ে স্টাটাস, শহরবন্দী মেঘ, romantic story, love story, short story, WriterMosharef

আমি দাঁড়িয়ে আছি এক বিশাল রাজপ্রাসাদতুল্য বাড়ির সামনে।

দেখে মনে হয় কোন রাজা মহারাজার বাস এখানে।
তবে এই প্রাসাদের সাথে এই প্রকান্ড লোহার ফটক কোন মতেই মানানসই লাগছে না আমার কাছে।

এমনকি রঙটাও মানানসই লাগছে না। হতে পারে যখন এটা লাগানো হচ্ছিল বা রঙ করা হচ্ছিল তখন এই বাড়ির মালিক এতটা নজর দেননি। যার ফলে এত সুন্দর রাজপ্রাসাদের মত বাড়িটাকে দেখতে বস্তির মত মনে হচ্ছে।

আমি ফটকের সামনে গিয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে এর গায়ে কয়েকটা টোকা মারলাম। কয়েক মূহুর্ত পরেই এতবড় গেটের কোণার দিকে জানালার মত একটা অংশ খুলে গেলো। একটা লোক উঁকি দিলো সেই অংশ দিয়ে। বোধহয় দারোয়ান। চোখদুটো একটু একটু
লাল। হয় ঘুমাচ্ছিল নয়তো এমনিতেই লাল।

কাকে চাই?
মিসেস রওশনকে চাই। উনার সাথে দেখা করতে এসেছি।

আপনি কে? কি হোন ম্যাডামের?
উনার আত্মীয় হই।
কেমন আত্মীয়?
এত কিছু বলা লাগবে না। বলবেন আবির রায়হান এসেছে কানাডা থেকে। তাহলেই হবে।
আচ্ছা একটু দাঁড়ান।

লোকটা ঠুস করে জানালাটা আটকে দিলেন। মিনিট দুয়েক পরে ক্যাঁচ করে ফটক খুলে গেল। লোকটা এসে বললো, আমার সাথে সাথে আসেন।

আমি লোকটার পেছন পেছন গেলাম। বাড়ির সামনের বাগানটা দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে গেল। নিশ্চয়ই অনেক সময় ব্যয় করে অনেক যত্নে এই বাগান করা হয়েছে। এর আগে এত সুন্দর বাগান আমি কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়েনা।

বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে আমার মুখ হা হয়ে গেল। বাপরে বাপ! একেবারে বাংলা ছবির চৌধুরি সাহেবদের বাড়ির মতই প্রকান্ড।

দুইদিক দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে বাড়ির মালিক জমিদার রকমের বড়লোক। আমাকে সোফায় বসতে বলে লোকটা যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকে চলে গেল। হয়তো এখন আবার গিয়ে দিবানিদ্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়বে।

একটু পরেই একটা অল্পবয়সী মেয়ে সিঁড়ি বেয়ে আসলো। পরনে জিন্স আর টি শার্ট। কানে এয়ারডটস। গান শুনছে বোধহয়, কারণ মাথাটা ছন্দ করে নাড়ছে। হয়তো বাইরে যাচ্ছিল। আমাকে দেখেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। এক কান থেকে এয়ারডট খুলে আমার দিকে
তাকিয়ে বললো, আপনি কে? কাকে চান? বাবা তো একটু বাইরে গেছে। আসতে দেরী হবে।

মেয়েটার কথা শুনে আমি হাসলাম। তারপর বললাম,
অনু, ভাল আছিস তুই? আমাকে চিনতে পারছিস?
মেয়েটা অবাক হয়ে গেল এবং কিছুটা ভড়কে গেল। হয়তো ভাবছে আমি মেয়েটার নাম জানলাম কিভাবে।

তাও এই নাম যা তার ঘরের লোক ছাড়া আর কেউ জানে না। সরি আপনাকে চিনতে পারলাম না। আর আপনি আমাকে তুই করে বলছেন কেন? আমাকে আমার বাবা মা আর বোন ছাড়া কেউ তুই করে
বলে না।

আমাকে চিনতে পারলি না? আচ্ছা একটু পর চিনতে পারবি। এখন কোথায় যাচ্ছিস নাকি? যাসনে কোথাও। গেলে আমার পরিচয় জানতে পারবি না।

দেখুন সবার প্রথম তো আপনি আমাকে তুই বলে ডাকা বন্ধ করুন। আর দ্বিতীয়ত আপনার পরিচয় জানার দরকার নেই আমার। অনু পুরোপুরি রেগে গিয়ে কথাগুলো বললো। এবং কিছুটা উচ্চস্বরে। ওর কথা বলার শব্দে সিঁড়ি বেয়ে আরেকটা মেয়ে নেমে এলো।

এই মেয়েটা আমার বয়সী। মেয়েটার পরনে শাড়ী, নাকে নাকফুল। বিয়ে হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভবনা আছে।

যদিও আজকালকার বাঙালী মেয়েরা বিয়ে ছাড়াও নাকফুল পরে। আমি মেয়েটাকে বললাম, তনু আপা ভালো আছো তুমি? তোমার বিয়েতে আসতে পারিনি।
সরি। রাগ করোনি তো তুমি আমার উপর?

মেয়েটাও অনুর মতই অবাক হলো এবং হয়তো ভড়কে গেল। কারণ তার এই নামটাও ঘরের মানুষ ছাড়া কেউ জানে না।

কে আপনি? আমার এই নাম জানেন কিভাবে?
তুমিও আমাকে চিনতে পারোনি তাহলে! খুব কষ্ট লাগলো। তোমার মাকে ডেকে আনো। উনারা আসলেই আমার পরিচয় পেয়ে যাবে।

নাকি উনিই তোমার বাবার সাথে বাইরে গেছেন?
উনারা দুজনেই বাইরে গেছেন। অনুর বিয়ের শপিং করতে।

ও আচ্ছা। অনুর বয়স আঠারো পার হয়ে গেছে? দেখে তো বাচ্চা মনে হয়। অনু কি তাহলে শপিং মলেই যাচ্ছিলি? ইশ তোকে আটকে দিলাম হয়তো। তবে এবার তাহলে সঠিক সময়েই এসেছি। বিয়ে খেয়েই যেতে পারবো।

অনুকে বাচ্চা বলায় ক্ষেপে গিয়ে কিছুক্ষন চিৎকার করলো আমার সাথে। তনু আপা ওকে সামলে উপরে পাঠিয়ে দিল। তারপর আমার সামনের সোফায় বসে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আধাঘন্টা পর একটা গাড়ী এসে থামলো বাড়ির সামনে। তারপর ঘরে ঢুকলো
মধ্যবয়স্ক একজোড়া নারী পুরুষ। পুরুষ লোকটা আমাকে দেখে তনু আপাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
দারোয়ান বললো তোর মায়ের কোন আত্মীয় নাকি কানাডা থেকে এসেছে? ইনি কি সেই আত্মীয়?

একথা বলে উনি আমার দিকে তাকালো। আমি তার কথা না শোনার ভান করে মহিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, মিসেস রওশন আমার বাবা কিছুদিন আগে মারা গিয়েছেন। মৃত্যুর আগে আমাকে একটা গল্প বলে গিয়েছেন। গল্পটা অসম্পূর্ণ রেখেই তিনি মেঘের গাড়ীতে চড়ে পাড়ি দিয়েছেন অজানায়। আমি সেই গল্পটার পুরোটা জানতে এসেছি। আশা করি আপনি গল্পের অসম্পূর্ণ অংশটা সম্পন্ন করতে পারবেন।

একথা বলে থামলাম। অনু ততক্ষনে নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। সবাই হয়তো ভাবছে আমি কে আর কিসব গল্পের কথা বলছি। সবাইকে এতটা সাসপেন্সে রাখা ঠিক হচ্ছে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া দুই তরুণ তরুণী। একে অপরকে পাগলের মত ভালবাসে। কারো পরিবার মেনে না নেয়ার ফলে দুজনে পালিয়ে বিয়ে করে। তারপর শুরু হয় টোনাটুনির সংসার। ছেলেটা একটা চাকরি করতো। অল্প বেতন, তবে দুজনের জন্য যথেষ্ট। অসীম
ভালবাসার মধ্যে দিয়ে দিন পার করছিল তারা। এরই মধ্যে পৃথিবীতে আসে তাদের কন্যা সন্তান। দুজনের আনন্দের সীমা নেই।

এই আনন্দের মধ্যেই বজ্রপাত হয়। ছেলেটার চাকরি চলে যায়। নেমে আসে অভাব অনটনের চাবুক সংসারের উপর। এরই মধ্যে মেয়েটা আবার কনসিভ করে। ছেলেটা হন্য হয়ে চাকরি খোঁজে। কিন্তু, চাকরি পাওয়া দুরুহ ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল আকালের বাজারে।

তবুও ছেলেটার চেষ্টার অন্ত নেই। এক সময় ভুমিষ্ঠ হয় তাদের পুত্র সন্তান। এক কন্যার পর এক পুত্র। ব্যাপারটা খুবই সুন্দর ছিল।

ছেলেটা সারাদিন রোদে হেঁটে হেঁটে চাকরি খোঁজে। রাতের বেলা কোনমতে ঘুমায়। ততদিনে টাকার অভাবে ভালবাসা ফিকে হয়ে আসে। এক সকালে ঘুম থেকে উঠে ছেলেটা দেখে তার পাশে তার ভালবাসার মানুষটা আর তার আদরের মেয়েটা নেই। শুধু একমাস বয়সী ছেলেটা শুয়ে আছে পেশাব আর পায়খানায় মাখামাখি
কাঁথায়। ছেলেটা দিশেহারা হয়ে তাদেরকে খোঁজে।

শেষে একটা চিরকুট পায়। তাতে লেখা ছিল যে তার স্ত্রী তাদের মেয়েকে নিয়ে ছেলেটারই এক বন্ধুর সাথে পালিয়ে গেছে। আমি এতটুকু বলে থামলাম। মধ্যবয়স্ক লোকটা রাগে কাঁপতে কাঁপতে আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো, ও ইউ সাটআপ। হু আর ইউ এন্ড হোয়াট দ্যা ফা* ইউ ওয়ান্ট?

পুরোদস্তুর ইংরেজিতে কথাগুলো বললো লোকটা। আমি আবারো লোকটার কথাগুলো অগ্রাহ্য করে মহিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, গল্পটা পরিচিত লাগে মিসেস রওশন? এবার আমি আমার পরিচয় দিই। আমার বাবার নাম ছিল ইকবাল খন্দকার। আমার নাম তানিম খন্দকার আবির। এই নামটা আমার বাবার স্ত্রী রেখে গিয়েছিল আমাকে ছেড়ে যাওয়ার আগে।

এই কথাগুলো বলার পরপরই ধপাস করে একটা শব্দ হলো। মিসেস রওশন মাটিতে পড়ে গেলেন। সাথে সাথে লোকটা এগিয়ে গেল সেদিকে। অনু আর তনু ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। দুজনের দৃষ্টি আমার দিকে। একটু পরেই মিসেস রওশন উঠে দাঁড়ালেন। আমার সামনে এসে কাঁপাকাঁপা হাতে আমার গাল স্পর্শ করলো। তার চোখে পানি।

আমার শরীর ঘৃণায় রিরি করে উঠলো। লোকটা একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সে পাথরের মূর্তির মত হয়ে আছে। একটুও নড়াচড়া নেই। আমি মিসেস রওশনের কাছ থেকে দূরে সরে গেলাম। তনু আপা বললো, মা এই ছেলে কি বলছে? কে এই ছেলে? আমি তনু আপাকে বললাম, আপা আমি তোমার ভাই। যাকে তোমার মা পাষন্ডের মত একা ফেলে রেখে এই লোকের সাথে পালিয়ে এসেছিল। যার ফলে তোমার আসল বাবা ছাব্বিশ বছর এক পাহাড় সমান কষ্ট বুকে চেপে রেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।

তনু আপা আবার প্রশ্ন করলেন, মা ও যা বলছে তা কি সত্যি? মিসেস রওশন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না। পারবেনই বা কিভাবে? উনার চোখমুখ সবকিছু বলে দিচ্ছে। তনু আপা কয়েক মূহুর্ত স্থির হয়ে তারপর হঠাৎ করেই ভাই আমার বলে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। এক পরম প্রশান্তিতে আমার পুরো শরীর জুড়িয়ে গেল।
আমিও আমার বোনকে জড়িয়ে ধরলাম। কিছুটা সময় এভাবেই কাটলো। তারপর আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অনুর কাছে গেলাম। ও অবাক হয়ে এসব দেখছে। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।

তুই বলেছিলি না যে শুধু তোর বাবা মা আর বোন ছাড়া কেউ তোকে তুই বলে ডাকে না। দেখেছিস আমি তোর ভাই। আমার তো তুই বলে ডাকার অনুমতি আছে তাই না? অনুর অবাক হওয়া চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো। আমি আবার মিসেস রওশনের কাছে ফিরে গেলাম। আবার আমার শরীর ঘৃণায় রিরি করে উঠলো।

বাবা ভাবতো আপনি বাবাকে ছেড়ে গেছেন কারণ বাবার ভালবাসায় কমতি ছিল। কারণ আপনি নাকি একবার বলেছিলেন সংসারে টাকার কমতি থাকলে সমস্যা নেই কিন্তু ভালবাসার কমতি থাকলে আপনি বাবাকে ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবেন। এই অংশ আসলে বাবা অসম্পূর্ণ রেখে গেছেন। বাবা আপনাকে
অন্ধের মত বিশ্বাস করতো। ছেড়ে চলে আসার পরেও উনি আপনার খোঁজ নিয়েছেন প্রতিনিয়ত। আসলে আপনি বাবাকে কেন ছেড়ে এসেছেন এটাই জানতে এসেছি। এটা জানতে পারলে গল্পটা সম্পূর্ণ হতো।

মিসেস রওশন চুপ করে রইলেন। কিছু বললেন না। আমি কিছুক্ষন অপেক্ষা করলাম। উত্তর না পেয়ে অনু আর তনুর কাছে ফিরে গেলাম।

যাই রে আপুরা। সন্ধ্যা সাতটায় ফ্লাইট আছে। যদি পারিস কখনো কানাডায় তোদের ভাইটাকে দেখতে আসিস। ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এখানে থাকতেও ইচ্ছে করছে না। ঘৃণায় বমি চলে আসছে।

আমি বেরিয়ে এলাম এক রাজনরক থেকে। বাইরে এসে বুক ভরে নিশ্বাস নিলাম। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম, বাবা তোমার স্ত্রী তোমাকে ভালবাসার অভাবে ছেড়ে যায়নি। ছেড়ে গিয়েছিল টাকার অভাবে। তোমার বড় মেয়ে ভাল আছে। নাকে নাকফুল আছে। তারমানে কি জানো তুমি? তারমানে বিয়ে হয়ে গেছে। তুমি তো জানতে। আমাকে একবার বললে না কেন?
আকাশ লাল হয়ে গেছে। ঢেকে গেছে লাল মেঘে। ঠিক যেন আমার মনের মত।
Previous
Next Post »