Girl in a Sari |
মাত্র বার্গারটায় কামড় বসিয়েছি, তারপর যা দেখলাম তাতে আমার চোখ মহাকাশ স্পর্শ করার জোগাড় হল। একটা শাড়ি পড়া মেয়ে, আমি এবার নিশ্চিত এবার আপনার চোখ মহাকাশ স্পর্শ করবে। আরে ভাই থামুন, আগে বলে নি আমি কোথায়? আমি অধিরাজ, বসে আছি ক্যালিফোর্নিয়ার একটা ফাষ্টফুড শপে। বসে বসে সন্ধ্যাকালীন পত্রিকায় ছাপার জন্য কিছু ছবির এডিটিং এর কাজ করছি। ক্ষিদে পেয়েছে, তাই একটা বার্গার অর্ডার দিয়েছিলাম, মাত্র কামড়টি বসিয়েছি তখনই ঢুকল মেয়েটা।
আন্দাজ পাঁচ ফুট তিন, দেখলেই বুঝা যায় কানাডিয়ান। তবে শাড়িটা নিখুত ভাবে পড়েছে, আঁচল দেওয়াও দারুন করে। হাত খোঁপা করা চুলে পার্ল লাগানো। মাথায় দুষ্টবুদ্ধি চাপল। এই মেয়ে কে জানতে হবে। আমি তাই সরাসরি সামনে গিয়ে বাংলায় কথা বলা শুরু করলাম।
Hi আমি অধিরাজ, আমি এখানের একটা দৈনিকে কাজ করি, ফটোগ্রাফার। ফটোগ্রাফি আমার জান, ফটোগ্রাফি আমার প্রান।
বাই দ্যা রাস্তা, আমি কি আপনার একটা ছবি তুলতে পারি? মেয়েটা অবাক হল কিনা বুঝা গেল না। তবে মেয়েটা যা বলল আমি অবাক হয়ে গেলাম। চোস্ত বাংলায় বলল আমি জেনিফার। জেনি করিম। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া থেকে একটা পিএইচডি পাবার চেষ্টা করছি। জেনি করিম তারমানে আপনি বাংলাদেশী? না, কানাডিয়ান।
কিছু মনে করবেন না। আপনি কি আমার হাতে একটা চিমটি কাটবেন? কেন? আমি দেখতাম আমি আমার এপার্টমেন্টে ঘুমিয়ে আছি কিনা? আশা করি নি, তবুও জোকসটা ধরতে পারল জেনি। হো হো করে হেসে উঠল।
তার হাসি থামলে আমি আবার বললাম,
এত সুন্দর বাংলা কার কাছ থেকে শিখলেন? আর শাড়ি পড়া? আমার স্বামীর কাছ থেকে।
এত সুন্দর বাংলা কার কাছ থেকে শিখলেন? আর শাড়ি পড়া? আমার স্বামীর কাছ থেকে।
অহ। তাহলে কোথায় আপনার স্বামী তাকে তো দেখছি না। সে আর থাকে না আমার সাথে, সে বাংলাদেশ। মাস তিনেক আগে আমাকে সে ডিভোর্স দিয়েছে। আমি জ্যোতিষী নই, কিন্তু একটা গল্পের গন্ধ পাচ্ছি, কাইন্ডলি আমাকে বলবেন যদি কিছু মনে না করেন। জেনি ঝাড়া পাঁচ মিনিট আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল? বলছি।
ঠিক আছে, আপনি শুরু করুন, আর আমি ল্যাপটপে কাজ করি। সন্ধ্যার আগে ছবি জমা দিতে না পারলে এডিটর আমার পিঠের ছাল তুলে নিবে। এই ছোট রসিকতায় ও জেনি প্রচুর প্রচুর হাসল। তারপর বাংলা ভাষায় বলা শুরু করল তার গল্প।
আমার পুরো নাম জেনিফার লরেন্স। আমার বাবা মারা গেছেন। আর মা ভেগে গেছেন বাবার বন্ধুর সাথে। কানাডাতে এসব অহরহ ঘটছে।
নতুন কিছু না। তখন আমার বয়স বিশ। তারপর কিছুদিন বোহেমিয়ানদের মত ঘুরলাম। অড জব করলাম। কিছু টাকা হাতে আসতেই চলে এলাম ক্যালিফোর্নিয়া। ক্যালিফোর্নিয়া এসে এখানের গ্র্যাজুয়েশন কোর্সে এডমিট হলাম। আর একটা ছোট জব নিলাম। সারাদিন ক্যাম্পাসে থাকি, রাতের বেলা ডিউটি, ডিউটির ফাকে ফাকে ঘুম। এভাবে দিন যাচ্ছিল। তখনই হঠাৎ দেখা হল একটা ছেলের সাথে ছেলেটাকে দেখেই বুঝতে পারলাম, সে এশিয়ান। চুপচাপ, একা একা থাকত। রোদে পোড়া বেশ মায়াময়
চেহারা। আমি আস্তে আস্তে তার সাথে ভাব জমালাম। বছর ঘুরতেই আমরা দুজনেই বুঝতে পারলাম আমরা আসলে মেড ফর ইচ আদার। সে আমাকে তার পরিবার সম্পর্কে জানাল, আমি তাকে আমার অতীত জানালাম। দেখা গেল কারোর কোনো মাথা ব্যাথা নেই ভবিষ্যত নিয়ে। হঠাৎ করে সে আমাকে প্রোপোজ করে বসল বিয়ের জন্য। আমিও ওকে ভালোবাসে ফেলেছিলাম। বিয়ে করে ফেলি আমরা।
বিয়ের পর সে বলল সে আমাকে তার বাবা মার কাছে নিয়ে যাবে। তবে আমাকে পুরো বাঙালী কালচার শিখতে হবে। আমি পুরোদমে শিখা শুরু করলাম। বাংলা ভাষা, বাংলাদেশী ম্যানার, বাংলাদেশী পোশাক, বাংলাদেশী ডিস রান্না এক কথায় সবকিছু। নিজেকে পুরো ওর ছাঁচে গড়ে তুললাম। দুই বছর পর যে আমি হলাম, তাকে নিজে দেখেই অবাক হয়ে গেলাম। পুরো বাঙালী, শুধু চামাড়াটা বিদেশীদের। তারপর গেলাম বাংলাদেশ, খুব ভয়ে ছিলাম তার পরিবার আমাকে মেনে নিবে কিনা। তবে আমার অবাক চোখের সামনে দেখলাম, সবাই আমাকে খুব ভালো ভাবে গ্রহন করেছে। সময়ের পরিক্রমায় আমার ননদ হয়ে উঠল আমার বান্ধবী, আমার শাশুড়ি হয়ে উঠল আপন মায়ের মত। একদিনের ঘটনা বলি, আমি রাতের বেলা না খেয়ে শুয়ে আছি, তখন মা এসে নিজের হাতে আমাকে ভাত খাইয়ে দিয়েছে। একদিন শপিং করতে গেছি, আশপাশের মানুষ আমাকে নিয়ে নানা মন্তব্য করছিল, মা সবাইকে কড়া কথা শুনিয়ে এসেছে।
ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ করে সবকিছু বদলে গেল। মা আর আগের মত নেই। ননদ ও আমাকে সহ্য করতে পারে না। আর আমার স্বামী পুরো স্যাডিস্ট হয়ে গেল। বাইরে থেকে এসে আমাকে না মারলে যেন তৃপ্তি পায় না। তারপরও আমি থেকে যেতাম। কিন্তু যে একদিন আমার অতীত নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমাকে ভালোবেসেছিল, আমাকে বিয়ে করেছিল, সে আমার মাকে নিয়ে কথা তুলল। জানি আপনি বলবেন, বিদেশে ফ্যামিলি বন্ডিং আলগা। তবে আমি আমার মাকে অসম্ভব ভালোবাসতাম। একদিন তাকে বললাম আমাকে ডিভোর্স দিয়ে আমাকে আবার ক্যালিফোর্নিয়া পাঠিয়ে দিতে। বিনা বাক্য ব্যয়ে আমাকে পাঠিয়ে দিল আবার। নিজে থেকে গেল। এখানে এসে আবার পুরোনো জব গুলো খুজে বের করালাম।
আবার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। এসব প্রায় বছর খানেক আগের কথা।
গল্পটা শুনার পর আমি কিছু সময় চুপচাপ থাকলাম। তারপর বললাম, তাকে এখনও মনে পড়ে? বলে পড়ে। তবে আগে ভালোবাসতাম, এখন ঘৃনা করি। এত কথা বললেন তবে তার নামটা তো বললেন না। জাবেদ করিম। আমি মনে মনে একটু হকচকিয়ে গেলাম। কিন্তু তারপরও বললাম, ছবি আছে? তার।
জেনি একটা ছবি এগিয়ে দিল, ছবি দেখে আমি পুরো সিউর হলাম এ অন্য কোনো জাবেদ না আমার বন্ধু জাবেদ। যে বছর খানেক আগে ক্যানসারে মারা গেছে। আমি গলা স্বাভাবিক রেখে বললাম, জাবেদ সাহেব কোথায় এখন জানেন? হয়তবা অন্য কোনো মেয়েকে তার সুন্দর দিকটা দেখিয়ে ঠকাচ্ছে।
বুজলাম জাবেদের মৃত্যুর খবর সে জানে না। আর এও বুঝলাম জাবেদ কেন স্যাডিষ্টের মত আচরণ করেছে। মেয়েটাকে আর পিছুটানে রাখেনি। জেনিকে মুক্ত বিহঙ্গের মত স্বাধীন করে দিয়ে গেছে নিজে খারাপ মুখোশ পরে। জাবেদ একজন কানাডিয়ান বিয়ে করেছে জানতাম। তবে মেয়েটা যে আমার সামনে বসে আছে কি ভাবে বুঝব। জাবেদের স্ত্রীকে আমি দেখিনি কখনও। আমি আর জেনিকে জাবেদের মৃত্যু সংবাদ দিলাম না। যেখানে জাবেদ কিছু বলেনি, আমার সেখানে বলা বেমানান। ক্ষতি কি হবে, যদি মেয়েটা জাবেদ কে ঘৃনা করেই ভালো থাকে। তবে আমি জানি,
জেনি এখনও জাবদকে ভালোবাসে। না হলে শাড়ি পড়ত না।
জেনি এখনও জাবদকে ভালোবাসে। না হলে শাড়ি পড়ত না।
(সমাপ্তি)