আমি শিমুর সাথে দীর্ঘ সাত বছর কথা বলিনি। যাকে প্রতিদিন একবার হলেও না দেখতে পারলে কিছুই ভালো লাগত না। তার সাথে কথা না বলে থাকাটা কত কষ্টকর তা আমি ছাড়া কেউ জানে না।
আড়ি কেটেছিলাম শিমুর সাথে। হাতের ছোটো আঙ্গুলটি দিয়ে আড়ি কাটতে হয় আর যে পর্যন্ত বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে আড়ি না ভাঙ্গবে সে পর্যন্ত কেউ কারো সাথে কথা বলা যায় না।
শিমুর আর আমার মামা ভাগনীর সম্পর্ক। একই এলাকায় থাকতাম, পাশাপাশি বাড়ি। ছোটোবেলা থেকে একসাথে হেসে খেলে বড়ো হয়েছি। যখন বাড়ির পাশে মাঠটিতে খেলতাম তখন আমাকে ছাড়া শিমু বা শিমুকে ছাড়া আমি অন্য কারো সাথে খেলতাম না। সম্পর্ক যদিও দূর সম্পর্কের মামা ভাগনীর, কিন্তু সমবয়সী থাকায় চলাফেরাটা বন্ধুর মতো।
একই সাথে স্কুলে যেতাম। কখনো খেলতে যেতে দেরি হলে বাসা থেকে এসে শিমু আমাকে নিয়ে যেত। তখন আমরা পঞ্চম শ্রেণীতে। একদিন মাঠে যেতে আমার দেরি হলো। কিন্তু শিমু আমাকে নিতে আসেনি। রাগী চেহারা নিয়ে মাঠে গিয়ে দেখি শিমু পাভেল নামের এক ছেলের সাথে খেলছে।
রাগটা চরমে উঠে গেল। পাভেলকে গিয়ে তাড়িয়ে দিলাম। শিমুকে হাত ধরে টেনে এনে জিজ্ঞেস করলাম,
--- তুই পাভেলের সাথে খেললি কেন?
--- তোর আসতে দেরি দেখে খেলেছি।
--- আমাকে আনতে বাসায় যাসনি কেন?
--- ভাবছি তুই কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবি।
--- এজন্য পাভেলের সাথে খেলতে হবে?
--- খেলেছি তো কী হইছে?
--- আচ্ছা যা, আমার সাথে খেলতে হবে না। কথাও বলবি না আমার সাথে।
--- তুইও কথা বলবি না।
--- তাহলে তোর সাথে আড়ি।
--- নে আড়ি কাট।
দু'জনে সত্যি সত্যিই আড়ি কেটে নিলাম। এখন থেকে আর কেউ কারো সাথে কথা বলব না।
পরেরদিন বিকেলে খেলতে গিয়ে শিমুকে খুঁজে পাচ্ছি না। ওর আসতে দেরি দেখে ওর বাড়ির দিকে যাচ্ছি। তখন মনে পড়ল, কাল তো আড়ি কেটেছি শিমুর সাথে।
থাক, মাঠে গিয়ে বসি। শিমু এসে আমার সাথে আড়ি না ভেঙ্গে থাকতে পারবে না।
অপেক্ষা করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। শিমু আর এলো না। পরেরদিনও এলো না। এবার ওর বাড়িতে যেতেই হবে। কথা না বলি, অন্তত কেমন আছে সেটা দেখে আসি।
শিমুদের বাড়িতে গিয়ে শিমুকে পাইনি। সে তার নানু বাড়িতে বেড়াতে গেছে।
মন খারাপ করে বাড়িতে আসার পথে কেঁদেই দিয়েছি। যদি আমি আড়ি না কাটতাম তাহলে শিমু নানু বাড়িতে যাওয়ার আগে অবশ্যই আমার কাছে বলে যেত।
ঘুড়ি ধরতে গিয়ে পা কেটে ফেলেছি। রাতেই গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। পরদিন আম্মু মাথায় পানি ঢেলে জ্বর কমাবার চেষ্টা করছে। শিমু কখন জানি দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। তার মানে নানু বাড়ি থেকে ফিরে এসেছে। আম্মু যখন ডাক দিয়ে শিমুকে ভিতরে আসতে বলল, তখন সে দৌড়ে চলে গেল।
দশ মিনিট পর শিমুর মা আসল। ঘটনা বুঝতে বেশি সময় লাগেনি। শিমু বাড়িতে গিয়ে কান্নাকাটি শুরু করেছে, আর থামেই না। যখন ওর মা বারবার প্রশ্ন করছে কী হইছে? তখন সে বলছে,
"শাওন পা কেটে বসে আছে। ওর গায়ে অনেক জ্বর।"
এর পরের সময়গুলো ছিল আরো অনেক কষ্টের। দু'জনেই মাঠে যেতাম খেলার জন্য। আমি ভাবতাম শিমুকে ছাড়া অন্য কারো সাথে খেললে সে কষ্ট পাবে, তাই খেলতাম না। সেও মনে হয় সেটাই ভাবত, সেও খেলত না। কেউ কারো সাথে কথাও বলতাম না। প্রতিদিন ভাবতাম শিমু এসে হয়তো আড়ি ভাঙ্গবে, কিন্তু ভাঙ্গত না।
আমরা বড়ো হতে লাগলাম। আমাদের অভিমানগুলোও বড়ো হতে লাগল। সাতটি বছর পাড়ি দিয়ে দিলাম। কেউ কারো সাথে কথা বলিনি। চার পাঁচজন একসাথে হলে আমি যেমন সবার সাথে কথা বলতাম, শিমুও বলত। কিন্তু আমাদের দু'জনের মধ্যে কথা হয়নি। এমনকি এলাকার কেউ বুঝতেও পারেনি আমরা যে কথা বলি না।
আমরা অনেক বড়ো হয়ে গেলাম। শিমুর বিয়ে ঠিক হলো। আমি তখন সাউন্ড সিস্টেমের সিনিয়র অপারেটর ছিলাম। গায়ে হলুদ, কনসার্ট সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপনার পাশাপাশি স্পীকারের অপারেটিং করতাম।
শিমুর বিয়ের গায়ে হলুদে স্পীকার এনে বাজানোর দায়িত্ব পড়ল আমার উপর।
দুইটা স্পীকারের কথা ছিল, আমি চারটা স্পীকার নিয়ে সেটিং করে বাজাচ্ছি। অনেকে উঠানে নাচানাচি করছে।
শিমু বসে আছে গায়ে হলুদের স্টেইজে। শিমুর মা, বড়ো বোন, বান্ধবী আর এলাকার অনেকেই ওর গায়ে হলুদ মেখে দিচ্ছে।
আমার এমন কষ্ট হচ্ছে যে, ইচ্ছে করছে দূরে কোথাও গিয়ে কেঁদে আসি।
সবাই শিমুকে হলুদ দিচ্ছে আর আমি তামাশা দেখছি। আমার কি ইচ্ছে করে না আমার ছোটো বেলার বন্ধুকে একটু হলুদ মেখে দিতে?
শিমু হঠাৎ গায়ে হলুদের স্টেইজে কান্না করছে। তাকে অনেকে প্রশ্ন করছে, "মেয়েরা কান্না করে বিয়ের দিন, তুই গায়ে হলুদে কান্না করছিস কেন?"
শিমু কান্নারত অবস্থায় স্টেইজ থেকে এসে আমার কাছে আসল। আমাকে হাত ধরে স্টেইজের কাছে নিয়ে গিয়ে কাঁদছে আর বলছে,,,
--- এই শাওন, কথা বলবি না আমার সাথে? আড়ি ভাঙ্গবি না? কালকে তো শ্বশুর বাড়িতেই চলে যাব। পরে তো তোকে চোখের দেখাও দেখতে পারব না। আমার গায়ে হলুদ মেখে দিবি না?
আমার চোখের পানি ধরে রাখার ক্ষমতা ছিল না তখন। অনবরত পানি পড়তেই লাগল চোখ দিয়ে। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
--- আড়ি ভাঙ্গ আগে, আমি হলুদ মেখে দিচ্ছি।
--- সাত বছর আগে তুই আড়ি কাটছস, তুই ভাঙ্গবি।
আমি বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে শিমুর হাত ধরে ওর আঙ্গুলের সাথে আড়ি ভাঙ্গছি।
শিমুর মা জিজ্ঞেস করছে, "তোরা মামা ভাগনী এভাবে কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে তোদের?"
তখন শিমু বলছে, "মা, শাওন আমার সাথে সাত বছর কথা বলেনি। এখন আড়ি ভাঙ্গছে।"
উপস্থিত সবাই অবাক। কী করে সম্ভব এটা? অন্তত এলাকার কেউ তো বুঝার কথা।
এর বছর দেড়েক পরে শিমুর ছেলে হয়েছে। ছেলেটাও শিমুর চেহারা পেয়েছে অনেকটা। মাস ছয়েক দেখা গেল আমাকে দেখলেই শিমুর ছেলে হাত বাড়িয়ে কান্না করত আমার কোলে আসার জন্য।
আরেকটু বড় হয়ে ওর মা'কে প্রতিদিন বলত, "মা দাদা যামু, মা দাদা যামু।"
অন্যান্য বাচ্চাদের দেখাদেখি শিমুর ছেলেও আমাকে দাদা ভাই ডাকত।
আজ যখন কয়েক বছর পর দেশের বাইরে থেকে শিমুর ছেলের সাথে কথা বলছিলাম, তখন সে বলছে,
"দাদা ভাই, তুমি বিদেশ থেকে আসার সময় আমার জন্য বিমান আনবা। না আনলে তোমার সাথে আড়ি।"
এই আড়ি কথাটা শুনেই এত কথা মনে পড়ে গেলা।
মামা ভাগনী বা বন্ধুত্ব শুধু নয়, কিছু সম্পর্ক জড়িয়ে থাকে হৃদয়ের অনেকটা জায়গা জুড়ে।