তৃপ্তির হাসি |
Hi I'm WriterMosharef
ব্যস্ত রাস্তা, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক। প্রতিদিন লক্ষ লোক চলাচল করে যারা কেউ কাউকে চেনে না৷
কেউ কারো দিকে দু'বার চোখ তুলে তাকিয়ে দেখেও
না খুব একটা সবাই ব্যস্ত এসব কেউ গায়েও মাখে না।
ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গিয়ে কাজের ফাঁকে ডুবে থাকা
মানুষগুলো দিনশেষে ঘরে ফিরলে তাদের দেখার জন্য আগ্রহী চোখগুলো অপেক্ষায় থাকে।
বড় রাস্তার পাশের ঝাঁকড়া সেগুন গাছটা যখন রাতের আঁধারে একটু শান্ত হয়ে বসে, তখন বাসতবাড়ির আম গাছের তলায় হাসির পসরা বসে, কখনো বা কান্না, কখনো অভিমানের।
যাচ্ছি নিজের ক্যাম্পাসে জাহাঙ্গীরনগর। বহুদিন যাই না। কেন শখ করে যাচ্ছি জানি না, শুধু জানি কিছুটা সময় হারিয়ে থাকতে চাই এটাও অবশ্য একসময়ের অস্থায়ী ঘর ছিল।
স্বামীর বাড়ি থেকে অভিমান করেই চলে এসেছি আপার বাড়ি৷ আপার শ্বশুরবাড়ি আমার একমাত্র যাওয়ার জায়গা।
মা বাবা গত হওয়ার পর নিজের বাবার বাড়ির কথা বলতে আপাকেই বুঝি।
মেয়েদের নিজের আর হয় কী? ছোটবেলা থেকে এক বাড়ি, তারপর আরেক। কোনোটাই পুরোপুরি নিজের হয় না।
আমার স্বামীর বাড়ি এখানে নয়, সিলেট নামক ছোট্ট শহরে। বাড়ির ঠিক পেছনে বিরাট একটা খোলা মাঠ আছে। কাচা সবুজ ঘাসের রাজ্য দূরে গাঢ় সবুজ গাছ।
মাঝে মাঝে আকাশ যখন ঘন নীল রঙে রঙিন হয়, থেমে থেমে বাতাস বইতে থাকে, সেই মোহনীয় রুপ দেখে থমকে যেতে হয়।
মনে হয় আল্লাহ রাব্বুল আ'লামিন খুব যত্ন করে
জায়গাটা সাজিয়ে রেখেছেন।
আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকি। তবে শুধু প্রকৃতি দেখতে নয়, মাঠটাতে প্রতিদিন বিকেলে দুটো মেয়ে খেলতে আছে। দুজন প্রায় সমবয়সী। ফ্রক পরে ঘুরে ঘুরে খেলে নানা রকম পাতা সাজিয়ে রান্নাবাটি খেলে।
আমার প্রচন্ড ইচ্ছে হয় ওদের কাছে যেতে, কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠে না। একবেলা কাছে পেলে আরও পেতে ইচ্ছে করবে যে।
আপার তিনটে ছেলেমেয়ে। সবচেয়ে ছোটটা আমায় আম্মু বলে ডাকে। আমি আপাকে প্রায়ই বলি, আমাকে একটা বাচ্চা দিয়ে দে আপা আপা পারে না। আমার কষ্ট সে বুঝতে পারে, কিন্তু নিজের সন্তান দিয়ে দেয়ার মতো শক্ত মনের মা হওয়া কি আর সহজ কাজ?
সেদিন খুব করে আপাকে ধরলাম, অর্পাকে নিয়েই যাব।
আপা হঠাৎ, করে বলে বসলেন, নিজের বাচ্চা হয়নি বুঝবি কী করে ছেড়ে থাকতে কেমন লাগে? চাওয়া অনেক সোজা, কষ্ট করে জন্ম দিয়ে তাকে পৃথিবীতে আনা অনেক কষ্ট৷ তুই আর আমার বাচ্চাদের দিকে
নজর দিবি না।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম শুধু। উঠে এসে ছিলাম চুপ করে।
রাতটা নির্ঘুম কেটেছিল জেগে ছিলেন আপাও। আমার শিয়রের পাশে বসে অঝোরে কেঁদে গেছেন সারারাত।
মুখ ফসকে বলে ফেলা কথার জন্য। আমি মনে মনে তখনও ভেবেছি, আপা যদি একবারও বলতো, নিয়ে
যা অর্পাকে।
নাহ্ সেকথা একটিবারও বলেনি।
রূপুর সাথে আমার সংসার সাড়ে আট বছরের। ওর আমার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। কাজপাগল মানুষ রোজ অফিসে যায়, রাতে ফেরে, খায়দায় ঘুমায়।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় জীবনের প্রতি খুব বেশি কিছু চাওয়ার নেই তার। যে কেউ দেখে বলবে সুখী মানুষ।
আমারও তাই মনে হয় সে বুঝতে দেয় না কিছু। কখনো গভীর রাতে ঘুম ভাঙলে দেখি সে জেগে আছে।
কপালের ওপর হাত উঠিয়ে দিয়ে অপলক সিলিঙের দিকে তাকিয়ে আছে। কখনো বেড়াতে আসা বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে থাকে তৃষ্ণা নিয়ে কিন্তু, কোলে নেয় না।
ভাব এমন যে বাচ্চাকাচ্চা পছন্দ নয়। দত্তক নেয়ার কথা
বললে বলে, প্রয়োজন নেই আমার বাচ্চা চাই না।
আমাকে সে কখনো কথা শোনায়নি। একটা বারও বলেনি তোমার দোষ তোমার সমস্যা। আরেকটা বিয়ে করলে ঠিক তার সন্তান হতো। আমার শ্বাশুড়ি অবশ্য বেশ কড়া। বিয়ের পর ছোট ছোট বিষয়েও কথা শোনাতে ছাড়েনি। সেই তিনিও কেন যেন সন্তানের
বিষয়ে কিচ্ছু বলেনি। রূপুই হয়তো কিছু বুঝিয়ে রেখেছে।
তবু মানুষটা বড্ড বেশি নীরব যেন। কখনো যদি কিছু বলতো, আমিও দুটো কথা বলতাম, ঝগড়া শেষে একে অপরকে জড়িয়ে কিছুটা কেঁদে নিতাম, শান্তি লাগতো বুঝি। এভাবে কষ্টের পাথর বয়ে বেড়াতে কার ভালো লাগে।
মানুষ নামক প্রাণীটা একটু বেশিই অভিমানী। সব পেলেও যেন একটু না পাওয়া বুকের ভেতর খচ খচ করে। এইতো বাংলাদেশের হাজার মানুষ কত কত কষ্টে বাস করে, আমি সেসব থেকে মুক্ত। সন্তান না হওয়ার কষ্টটুকুই আমার জগতের যাবতীয় কষ্টের মধ্যে সব চেয়ে বড় মনে হয়। অভাগী নারী জীবনের অন্যতম অপূর্ণতা।
ক্যাফেটেরিয়ার জায়গাটা বেশ ভিড়। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বহু কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হলো আমি অতীতে ফিরে গেছি।
হৈ হল্লা করছি। চিন্তা ভাবনাহীন সে জীবনটা সাধেই কি বলে, ছাত্রজীবন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। তবুও কত বিষয়ে কষ্ট পেতাম, ডিপ্রেশন ঘেরাও করে নিতো চারপাশ। আচ্ছা মানুষ কি কখনো পুরোপুরি সুখী হয়?
ছোট্ট একটা ময়লা হাত। হাতে দুই টাকার একটা ছেঁড়া নোট আমার দিকে বাড়িয়ে রেখেছে হাতটা। ফ্যালফ্যাল করে দুটো অসহায় ডাগর ডাগর চোখ তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
মেয়েটার বয়স হয়তো ছয়-সাত হবে। রঙ জ্বলা জামা গায়ে, চুলগুলো রুক্ষ, লাল।
সাহায্য চাইতে এসেছে।
আমি পার্সে হাত দিলাম না। সৃষ্টিকর্তা আমার কাছে বাচ্চাটাকে এমনি এমনি পাঠায়নি। ও সাহায্য চাইতে নয়, করতে এসেছে। আমি ওর হাতটা শক্ত করে ধরে ফেললাম। টেনে ওকে কাছে নিয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। কতক্ষণ ছিলাম জানি না। বাচ্চাটাও কিচ্ছু বলেনি।
যখন ওকে ছাড়লাম, দেখলাম চারপাশে মোটামুটি
একটা জটলা। আগ্রহী চোখে তাকিয়ে আছে অনেকেই।
আমি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম, নাম কী তোমার?
তৃপ্তি।
বাবা মা কী করে? ভিক্ষা করো কেন?
বাপ মা নাই।
কার সাথে থাকো?
দাদীর সাথে, দাদী মইরা গেছে গত মাসে।
এখন?
একলাই থাকি, বিরিজের তলে লুকাইয়া শুইয়া থাকি রাইতে, দিনে ভিক্ষা করি।
বলেছিলাম না, সাহায্য এসেছে। এজন্যই বাবা মা ছাড়া বাচ্চাটা পাঠিয়ে দিয়েছে আল্লাহ আমি জিজ্ঞেস করলাম যাবে আমার সাথে আমার বাড়ি?
কাম করতে? আমি বাড়ির কাম পারি না। আগেও এক বাড়িতে গেছিলাম হেরা রাখে না আমারে।
আমি আবারও তাকে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, কাজ করতে না। আমার মেয়ে হয়ে থাকবি৷ মা ডাকবি। স্কুলে পড়বি। একটা বড় মাঠ আছে আমার বাড়ির কাছে।
সেখানে খেলবি। যাবি?
তৃপ্তি ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না। তাকিয়ে রইল অবাক হয়ে। আপার বাড়িতে ফিরে দেখলাম রূপু এসেছে। আমার একহাতে তখন তৃপ্তির হাত ধরা।
ও বলল, চলো এবার। অনেক থেকেছ। আমি একা অত
বড় বাড়িতে থাকতে পারি নাকি?
অভিমান ঠেলে এলো। বললাম, কতো কথা বলো বুঝি আমার সাথে?
সেই তুমি একলাই থাকবে, আমি থাকলেও, না থাকলেও। সে কথা ঘুরিয়ে তৃপ্তির কথা জিজ্ঞেস করল।
বললাম, নিয়ে যাব ওকে। ও আমার মেয়ে।
রূপুর কয়েক মুহূর্ত লাগলো ব্যাপারটা বুঝতে। তারপর বলে উঠল, আমাদের মেয়ে?
না, শুধু আমার।
তোমার একার কী করে হয়?
একারই তো। ও আমায় মা ডেকেছে। আর তোমায় ডাকবে আঙ্কেল। আমি দেখলাম বহুদিন পর রূপু আগের মতো হাসলো। যে হাসিটা দেখে প্রথম প্রেম হয়েছিল ওর সাথে।
এগিয়ে এসে তৃপ্তির হাত ধরে বলল, তুমি আমাকে কী ডাকবে?
জানি না।
বাবা ডাকবে?
বাবা।
আবার বলো তো?
বাবা।
রূপু একটু কেঁপে উঠল। তারপর জড়িয়ে ধরল মেয়েটাকে। ওর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু ও আটকে রাখছে। ভয়ানক দৃশ্য।
আমি থাকতে না পেরে যোগ দিলাম তাদের সাথে।
তৃপ্তির হাসি মুখ টা দেখে মন ছুঁয়ে গেছে আমাদের।
মানুষ কি সত্যি অপূর্ণ থাকে? সৃষ্টিকর্তার ভান্ডার তো অফুরন্ত। প্রতিটা খালি জায়গা ঠিক ঠিক পূরণ হয়ে যায়।